পটুয়া সমাজ ও বিবর্তন
পশ্চিমবঙ্গের চিত্রকর সমাজ হল একটি দৃষ্টান্ত।পুরো লোক সমাজ এদের কে পটুয়া নামে পরিচিত। পেশায় যদিও এরা হিন্দু দেব-দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে পট-চিত্রাঙ্কন ও সঙ্গীতসহ প্রদর্শন,পুতুল তৈরি ও প্রতিমা নির্মান, কিন্তু জাতি হিসাবে এরা বৈচিত্র্য। না হিন্দু, না মুসলমান।
পটুয়ারা প্রায় প্রত্যেকেই সবাই হিন্দু সমাজের, কেবল মুসলমান সমাজের বাইরের কতকগুলো সামাজিক কর্তব্য তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে। এরা হিন্দু নাম বহন করে এবং নামের শেষে পদবী রাখা হয় চিত্রকর। এদের বিবাহের অনুষ্ঠান হয় একদমই চিত্রকর সমাজের মধ্যে। বিবাহ অনুষ্ঠানে মৌলবি এসে ইসলাম ধর্মমতে কলমা পড়িয়ে যেতেন। আবার হিন্দুদের মতো বিয়ের সময় গায়ে হলুদ, বিবাহের পরে হিন্দু-রীতি মেনে সিঁথিতে সিদুর দান এবং শাখা-পরানো ইত্যাদি ও পালন করা হত।
হিন্দু ঠাকুর-দেবতা নিয়ে পটুয়া দের কাজ-কারবার---তাই এদের গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। নামাজ পরার যেমন রীতি ছিল এদের সমাজের মধ্যে তেমনি মেয়েদের লক্ষীপুজো করার ও রীতি ছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য যে, এরা দুটি সমাজের মধ্যবর্তী স্থানে এসেই থেমে গেছে। এরা সম্পূর্ণভাবে না হতে পেরেছে মুসলমান সমাজের আবার না হতে পেরেছে হিন্দু সমাজের।
চিত্রকররা নিজেদের বিশ্বকর্মা পুত্র বলে পরিচয় দেয়---তাই তারা বিশ্বকর্মা পুজো করে। মুসলমানের কিছু কিছু রীতি-নীতি পালন করলেও তারা সারাজীবন ধরে হিন্দু দেব-দেবীর মাহাত্ম্য কথা শুনিয়ে, পট এঁকে, পট দেখিয়ে, মূর্তি বানিয়ে দিন যাপন করেছে । আর এটাই হল পটুয়া দের জাতিগত ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য।
পারিপাশ্বিক অবস্থার চাপে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার কারণে পটুয়া দের পেশা গত জীবনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
পেশাগত জীবনে পরিবর্তন আসার কারনে পটুয়া দের আত্মকথা
1,,,হাওড়া জেলার প্রশস্ত গ্রামের পটুয়ারা না হিন্দু, না মুসলমান। জাতিগত অবস্থা নিয়ে, কিভাবে সামাজিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে যে সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল তা জানা যায় বেচু চিত্রকর -এর থেকে। প্রশস্ত গ্রামটিতে ছয়-সাত ঘর চিত্রকর-পটুয়াদের বাস।এদের কেউ পট আঁকে না, পট দেখিয়ে গান ও করে না। এরা পুরো-পুরি হিন্দু দেব-দেবী দের মূর্তি নির্মাণ করে নিজেদের পেট চালায়। এরকম অবস্থা সৃষ্টি কিভাবে হল, জানতে চাইলে বেচু চিত্রকর জানালেন যে আগে তারা হিন্দুর নিয়মকানুন পালন করতেন এবং মুসলমানদের মতো নামাজ পড়তেন। আদতে তারা ছিলেন হিন্দু।কিন্তু মুসলমানদের রাজত্বকালে তাদের বেগমদের ছবি আকার জন্য তাদের ডাকা হত।কাজের জন্য তাদের মোটামুটি দাম ও দেওয়া হত। ফলে কাজের জন্য মুসলমানদের সাথে পটুয়া দের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল। কিন্তু সেটা ঘৃনার চোখে দেখতে শুরু করল হিন্দুরা। এই নিয়ে সুপ্ত অশান্তি চলতেই থাকল। আর, তার মধ্যে গোদের বিষ ফোঁড়ার মতো জাকিয়ে বসল জাতিগত ও শ্রেণীগত নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা। ফলে সমাজের মাথা রা দাবি জানালেন যে হয় পটুয়া রা সম্পূর্ণভাবে হিন্দু সমাজের হোক আর না হয় ,সম্পূর্ণভাবে মুসলমান সমাজের হোক। তাই তখন পটুয়ারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে নিয়ে তারা হিন্দু হবার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তখন সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্বামীজিরা এসে পটুয়া দের শুদ্ধি করে দিয়ে হিন্দু সমাজের করে দেয়।
2,,মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া থানা এলাকায় কেশববাড় নামক গ্রামে ছয় ঘর পটুয়া বাস করেন। এদের মধ্যে এখনও তিনজন পটুয়া পট দেখিয়ে গান গেয়ে পেট চালায়। এদের বাড়ির মেয়েরা পুতুল তৈরি করে। বাকি দু ঘর পুতুল ও প্রতিমা নির্মান করেন। আর বাকি তিন ঘর ঐ হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গার স্বীকার হয়ে শুদ্ধিকরনের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে হিন্দু সমাজের হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে সতীশ চিত্রকর জানিয়েছেন যে,তার পরিবার ছাড়া বাকি দুই ঘর বেশিরভাগ সময় নেশায় ডুবে থাকত বলে ওরা হিন্দু সমাজ থেকে বাতিল হয়ে গেছিল। তাই ওরা অর্ধ হিন্দু আর অর্ধ মুসলমানদের জীবন অতিবাহিত করত।
Comments
Post a Comment